28.1 C
Los Angeles
Thursday, December 19, 2024

বিশেষ সংবাদ Featured News

৩৮ বছর ধরে বিষাক্ত তেজস্ক্রিয়তার মধ্যে বাস, চেরনোবিলের পথকুকুরেরা এখন ‘সুপারডগ’!

বিজ্ঞানীদের ধারণা, চেরনোবিলের বিষাক্ত পরিবেশে মানিয়ে নিয়েছে...

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০ প্রমোদতরি

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০ প্রমোদতরি,আধুনিক সময়ের প্রমোদতরিগুলো...

শীতে কদর বেড়েছে খেজুর রসের

শীতে কদর বেড়েছে, আবহমান বাংলায় শীত মৌসুমে...

সুন্দরবনে বৈশেল জেলেদের সাথে এক দিনের অভিজ্ঞতা: ‘দাওন’ দিয়ে মাছ ধরা

অন্যান্যসুন্দরবনে বৈশেল জেলেদের সাথে এক দিনের অভিজ্ঞতা: 'দাওন' দিয়ে মাছ ধরা

সুন্দরবনে বৈশেল জেলেদের, অর্ধেক ভাটা হয়ে গেছে। সুন্দরবনের খাল-নদী থেকে পানি কলকল শব্দে নেমে যাচ্ছে। দুই পাশে ঘন বন আর সুন্দরী, গরান, গেওয়া, বাইন, গোলপাতাসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছের ছায়া। ঝপঝোপিয়া নদী ধরে বৈশেল জেলেদের দুটি ডিঙিনৌকা উজানে, অর্থাৎ স্রোতের বিপরীতে চলছে। তাঁরা ডিঙিনৌকা নিয়ে সুন্দরবনে ঢুকে নদী ও খালে বড়শি দিয়ে মাছ শিকার করেন। স্থানীয়ভাবে এ জেলেদের ‘বৈশেল’ বলা হয়।

গত মঙ্গলবার বৈশেল জেলেদের সঙ্গে তাদের মাছ ধরার দৃশ্য দেখতে যাওয়ার সুযোগ ঘটে। ছোট দুটি ডিঙিনৌকায় ছিলেন কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী এলাকার বৈশেল জেলের সদস্য পরিমল কুমার, মনোরঞ্জন মণ্ডল, গোবিন্দ মণ্ডল ও বিপ্লব কুমার। তারা বংশপরম্পরায় সুন্দরবনের নদী ও খালে মাছ শিকারের কাজে যুক্ত। গল্প করতে করতে নৌকাগুলি এঁকেবেঁকে চলে গেল গহিন বনের মুচির খালে।

প্রবীণ জেলে গোবিন্দ মণ্ডল বললেন, ‘খালের মুখেই বড়শি ফেলব। কিন্তু বড়শির আধার কোথায়? মাছ ধরতে হলে চিংড়ি লাগবে।’ তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই নৌকার পাটাতনের নিচ থেকে জাল বের করে লাফিয়ে খালের মধ্যে নেমে পড়লেন মনোরঞ্জন। তিনি বললেন, ‘চিন্তার কারণ নেই, চিংড়ি ধরতে জাল এনেছি।

বৈশেল জেলেদের মাছ ধরার গল্প

কয়েকবার জাল ফেলতেই বড়শির আধার হিসেবে প্রয়োজনীয় চিংড়ি জোগাড় হয়ে গেল। ঝটপট কয়েকটি বড়শি নিয়ে সুতায় বেঁধে তৈরি হলো হাতবড়শি। সুতার মাথায় ভর হিসেবে বাঁধা হলো কিছু লোহার তালা এবং নাট-বল্টু। এরপর বড়শিতে আধার গেঁথে ছুড়ে ফেলা হলো মাঝখালের দিকে।

কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরই টানে ধরা পড়ল মাছ। বিপ্লব কুমার সুতা টেনে তুললেন একটি বড় গাগড়া ট্যাংরা। বড়শি থেকে মাছ ছাড়াতে ছাড়াতে বললেন, সুন্দরবনের এটি একটি কম দামি মাছ। এই জঙ্গলের নদী ও খালে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। ঠিকঠাক রান্না করতে পারলে ভালোই লাগে।

এখন পরিমল হাঁক দিয়ে বললেন, “চলেন, সামনে আগাই। নলবুনিয়া খালের মুখে দাওন দেব। সেখানে মাছ বেশি।” “দাওন আবার কী? প্রশ্ন শুনে হাসতে হাসতে জেলে গোবিন্দ মণ্ডল বললেন, “দাওন মানে বড়শি, এটাও জানেন না!

বড়শি দিয়ে মাছ শিকারের জন্য আধার হিসেবে ব্যবহার হয় চিংড়ি। জাল ফেলে চিংড়ি ধরছেন জেলেরা। মঙ্গলবার সুন্দরবনের মুচির খালে। ছবি: সংগৃহীত

নলবুনিয়া খালে বৈশেল জেলেদের মাছ ধরার অভিযান

মুচির খাল থেকে বেরিয়ে ডিঙি দুটি নলবুনিয়া খালের মুখে পৌঁছায়। সেখানে গিয়ে নৌকায় বসে নতুন করে দাওন বড়শি তৈরি করতে শুরু করেন জেলেরা। লম্বা সুতায় একাধিক বড়শি গেঁথে তৈরি করা হলো দাওন। দাওনের প্রতিটি বড়শিতে একটি করে চিংড়ি গেঁথে পানিতে ফেলা হলো।

বিপ্লব কুমার বলেন, “দাওন দুভাবে পাতা যায়। বেশি ডুবিয়ে দিলে দাওনে ধরা পড়ে মেধ, মোচন, ট্যাংরা ও কাইন মাছ। আর ভাসিয়ে রাখলে দাওনে আটকা পড়ে পাতাড়ি-জাবাজাতীয় মাছ।” পরিমল যোগ করেন, “এখানে দাতিনা মাছও পাওয়া যায়। কপাল ভালো থাকলে তাইড়েলও পড়বে। তবে ভোলা মাছ আর গাগড়া ট্যাংরা প্রচুর রয়েছে।”

ডোবা দাওনের বড়শিগুলো পানির একদম নিচে ডুবে থাকে। লোহার নোঙর দিয়ে সারিবদ্ধভাবে ফেলা হয়। এই বড়শিতে আধার হিসেবে ব্যবহার করা হয় জঙ্গলের একজাতের ছোট কাঁকড়া, যা কাইন মাছের প্রিয় খাবার। ভাসা দাওন পাততে হয় জঙ্গলের পাশ দিয়ে, গাছের ভেতর ও শিকড়ের মাঝে লম্বা সুতার সঙ্গে বাঁধা বড়শিগুলো গাঁথা হয়। এক দাওনে থাকে শতাধিক বড়শি।

নৌকার পাটাতনের ওপর বসে হাতবড়শিতে আধার গেঁথে গোবিন্দ মণ্ডল বলেন, “সবাই একটু মাথাটা নিচু করেন।” কিছু না বুঝেই আমরা মাথা নিচু করে বসলাম। এরপর তিনি নৌকায় দাঁড়িয়ে বড়শির সুতা হাতে নিয়ে মাথার ওপর দিয়ে কয়েকবার ঘুরিয়ে ছুড়ে মারলেন। বড়শিসহ সুতার এক প্রান্ত উড়ে গিয়ে পড়ল অন্তত ১০০ হাত দূরে খালের মাঝ বরাবর। এভাবে আরও কয়েকটি হাতবড়শি ফেলা হলো খালে।

বড়শি ফেলে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। একের পর এক মাছ উঠতে শুরু করে। অনেকগুলো দাতিনা মাছ পাওয়া গেল, ট্যাংরা ও কাইন মাছও আটকা পড়েছে; তবে সেগুলো বড় নয়। বড়শি থেকে মাছ খুলে নৌকার ভেতর রাখা হচ্ছে। নৌকায় যেন কম্পন লেগেছে; মাছগুলো ছটফট করছে।

গোবিন্দ মণ্ডল বলেন, একসময় এই অঞ্চলে কাইন মাছের অভাব ছিল না। এক ভাটায় দাওন দিলে হাপর (বাঁশের তৈরি একধরনের খাঁচা) ভরে যেত। কিন্তু এখন আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। বিষ দিয়ে সব মাছ শেষ করে দিচ্ছে মানুষ। সুন্দরবনে সারা বছর চলে ওই অপকর্ম।

সুন্দরবনের খালে নৌকায় বসে বড়শি থেকে মাছ ছাড়িয়ে নিচ্ছেন এক জেলে। ছবি: সংগৃহীত

বিকেলের মাছ ধরা: বৈশেল জেলেদের অভিজ্ঞতা

ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে গেছে। নৌকার মাথায় বিশেষ কায়দায় বানানো টিনের চুলা বসানো হলো। নৌকার গলুইয়ে শুরু হলো মাছ কাটার কাজ। কিছুক্ষণ পর লবণ ও মসলা মাখিয়ে মাছগুলো চুলায় উঠল। শর্ষের তেল দিয়ে ভাজা মাছের স্বাদ ছিল অসাধারণ।

দুপুরের খাওয়া শেষ করতে করতে বিকেল হয়ে গেল। এবার পেতে রাখা বড়শিগুলো তুলতে হবে। শুরু হলো একটি–দুটি করে বড়শি ওঠানো। কিন্তু অনেকগুলো বড়শি তোলার পরও মাছের দেখা মিলল না। হঠাৎ করে একটি বড়শি টান দিলেই ঝপাৎ শব্দ হলো—মাছ বাঁধা আছে। সেটি ছিল ইলশে তাইড়েল, দেখতে যেমন সুন্দর, খেতেও নাকি মজার।

এরপর ট্যাংরা মাছ উঠল আরও কয়েকটি। বিপ্লব কুমার বললেন, “আমরা বৈশেলরা মাছ ধরতে মরা গোনে নামি। ভরা গোনের সময় বড়শিতে মাছ হয় না, কারণ ওই সময়ে স্রোত বেশি থাকে এবং মাছগুলো দাঁড়ায় না। কিন্তু মরা গোনে পানির চাপ কমে যায়, তখন মাছগুলো পানির নিচে দাঁড়িয়ে থাকে।”

গল্পে গল্পে সময় চলে গেল। জোয়ারের স্রোত কমে এসেছে তখন। আর আকাশে মেঘ জমেছে। দেরি না করে নৌকা ছেড়ে দেওয়া হলো। লোকালয়ে পৌঁছতেই ঝুম বৃষ্টি নামল। নৌকা থেকে বিদায় নেওয়ার সময় জেলেরা জানালেন, আগামীকাল ভাটিতে আমরা সুন্দরবনের আরও গহিনে নেমে যাব।

Check out our other content

Check out other tags:

Most Popular Articles