15.1 C
Los Angeles
Friday, October 18, 2024

বিশেষ সংবাদ Featured News

00:04:00

আওয়ামী লীগের দেড় ডজন মন্ত্রী-এমপি বিএনপিতে যোগদানের চেষ্টা?

ঢাকা, ১৫ অক্টোবর ২০২৪:বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন...

চাগোস দ্বীপপুঞ্জ মরিশাসের কাছে ফিরিয়ে দিচ্ছে যুক্তরাজ্য

চাগোস দ্বীপপুঞ্জ মরিশাসের,ভারত মহাসাগরে অবস্থিত সামরিক কৌশলগত...

আয়না ঘরের দুঃস্বপ্নের সেই সব দিন

জাতীয়আয়না ঘরের দুঃস্বপ্নের সেই সব দিন
বাংলাদেশে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে আয়নাঘরে ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর নির্যাতন নিয়ে রয়েছে নানা আলোচনা। তাঁর সরকারের পতনের পর সেই গোপন বন্দীশালা থেকে কয়েকজনকে মুক্তি দেওয়া হয়। তাঁদের কয়েকজনের জবানিতে উঠে এসেছে সেখানকার ভয়ংকর নির্যাতনের চিত্র। এ নিয়ে প্রভাবশালী মার্কিন গণমাধ্যম দ্য নিউইয়র্ক টাইমস কথা বলেছে আয়নাঘর থেকে মুক্ত কয়েকজনের সঙ্গে। ১৭ অক্টোবর প্রতিবেদনটি তাদের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত হয়।

আয়না ঘরের দুঃস্বপ্নের, দেশে ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতনের মাধ্যমে ১৭ কোটি মানুষের সামনে একটি নতুন ভবিষ্যতের দুয়ার খুলেছে। এ ঘটনার পরই তাঁর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত গোপন কারাগারে রাজবন্দীদের ওপর চালানো অমানবিক নির্যাতনের কাহিনিও প্রকাশ্যে এসেছে।

নির্যাতনের তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে আয়নাঘরের অনেক বন্দী মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন, কেউ বা মৃত্যুকে বরণ করেছেন। হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এই বন্দিশালা থেকে মুক্তি পেয়েছেন কিছু বন্দী। তাঁদের কেউ কেউ নিউইয়র্ক টাইমসকে শেখ হাসিনার প্রতিশোধপরায়ণ আচরণের শিকার হওয়ার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন।

যদিও একসময় গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন শেখ হাসিনা, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি স্বৈরাচারী মনোভাব এবং দমন-পীড়নের পথ বেছে নেন। ক্ষমতায় টিকে থাকতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে তিনি যেকোনো বিরোধী চ্যালেঞ্জ দমন করেছেন।

মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসাবমতে, ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬০৫ জন গুম হয়েছেন ।ছবি : প্রথম আলো

শেখ হাসিনার ক্ষমতা কুক্ষিগত করার কৌশলের মধ্যে জোরপূর্বক গুম অন্যতম ছিল। এই কৌশলের অংশ হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্বারা অপহৃত শত শত মানুষের কোনো সন্ধান মেলেনি। অনেক ক্ষেত্রে এসব ব্যক্তিকে টার্গেট করা হয়েছে সাধারণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য—যেমন বিক্ষোভ-সমাবেশ আয়োজন, রাস্তা অবরোধ, কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারবিরোধী মন্তব্য করার মতো তুচ্ছ কারণে।

ভুক্তভোগীদের অনেককেই হত্যা করা হয়েছে, আর অন্যদের কণ্ঠ রোধ করতে বছরের পর বছর আয়নাঘরের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আটকে রাখা হয়েছে। সেখানেও অনেকে মারা গেছেন। সৌভাগ্যক্রমে কয়েকজন এই বন্দিশালা থেকে মুক্তি পেতে সক্ষম হয়েছেন, এবং তাঁদের মধ্যে কিছুজন টাইমসকে তাঁদের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।

আয়নাঘরে কাটানো জীবন নিয়ে অনুভূতি প্রকাশ করেছেন মীর আহমেদ কাসেম আরমান, যিনি গত আগস্টে মুক্তি পান। বন্দীদের মধ্যে আরমানের মতো আইনজীবীর পাশাপাশি ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, কূটনীতিক এবং মানবাধিকারকর্মীরাও।

গুম–খুনে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে মায়ের ডাক। ১৪ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে সংগঠনটি। ফাইল ছবি

আয়নাঘর থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত এক বন্দী কয়েকবার স্ট্রোকের শিকার হয়েছেন। মুক্তির আগে জানতে পেরেছিলেন, তাঁকে মৃত ভেবে তাঁর স্ত্রী অন্যজনকে বিয়ে করেছেন। আরেকজন মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দী জানতে পারেন যে, তাঁর খোঁজে তাঁর বাবা বছরের পর বছর মানুষের দুয়ারে ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে মারা গেছেন।

আয়নাঘরে মারা যাওয়া মানুষের সঠিক সংখ্যা এখনও অজানা। তবে গুম হওয়া ব্যক্তিদের অনেক স্বজন আজও তাঁদের ফিরে আসার অপেক্ষায় দিন গুনছেন। তাঁদের দাবি, নিখোঁজ স্বজনদের ফিরিয়ে দেওয়া হোক, আর যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে গুমের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা হোক।

এমনই এক অপেক্ষমাণ স্বজন তাসনিম শিপরা। তিনি বলেন, ‘আমরা জানতে চাই, আসলে কী ঘটেছিল।’ তাসনিম জানান যে তাঁর চাচা বেলাল হোসেন ২০১৩ সালে নিখোঁজ হন। তিনি মনে করেন, হয়তো তিনি আর বেঁচে নেই।

দ্য টাইমস সাবেক বন্দীদের তিনজনকে আয়নাঘরের একটি ছবি আঁকার অনুরোধ করেছিল। তাঁদের আঁকা স্কেচে দেখা যায়, একটি দীর্ঘ করিডোর, যেখানে আধা ডজন কক্ষ মুখোমুখি অবস্থিত। করিডোরের দুই প্রান্তে দুটি শৌচাগার—একটি দাঁড়িয়ে এবং অন্যটি বসে ব্যবহারের জন্য। প্রতিটি কক্ষে ছিল একটি বড় এগজস্ট ফ্যান, যার কাজ ছিল বন্দীদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলা এবং যাতে নিরাপত্তারক্ষীদের আলাপ শোনা না যায়।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আহমেদ কাসেম আরমান। ছবি সংগৃহীত

‘কয়েকজনকে ছোট ভ্যানগাড়িতে তুলে শুইয়ে বেঁধে দেন রক্ষীরা।’

একদিন ভোর হওয়ার আগে কারারক্ষীরা আহমেদ কাসেম আরমানের কক্ষে প্রবেশ করেন, তখন তাঁর মনে হয়েছিল, এটাই হয়তো শেষ মুহূর্ত।

আরমানকে জানালাবিহীন একটি ছোট কারাপ্রকোষ্ঠে আট বছর বন্দী রাখা হয়েছিল, যেখানে প্রতিটি দিন ছিল যেন অন্তহীন অন্ধকার রাত। তবে সেই দিনটি ছিল ভিন্ন। ভোরের আলো ফোটার আগেই নিরাপত্তারক্ষীরা কক্ষে ঢুকে তাঁকে নামাজ শেষ করতে বলেন, তারপর খুলে দেন তাঁর চোখের পুরু বাঁধন এবং হাতকড়া।

“আমি সবসময় স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করেছি, যদি এ পৃথিবীতে আর কখনো আমার স্ত্রী ও দুই কন্যার সঙ্গে দেখা না হয়, তবে অন্তত বেহেশতে যেন আমাদের পুনর্মিলন হয়।”
— মীর আহমেদ কাসেম আরমান, আয়নাঘর থেকে মুক্তি পাওয়া বন্দী

আরমান ভেবেছিলেন, তাঁকে মেরে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হবে, অথবা ডোবার পানিতে ফেলে দেওয়া হবে। সেদিন ভোরে তাঁকে এবং আরও কয়েকজনকে ছোট একটি ভ্যানগাড়িতে শুইয়ে বেঁধে দেন রক্ষীরা। আরমানকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল দুজনের নিচে। গাড়ি ছুটে চলে এক ঘণ্টা ধরে।

তবে দেশের অনেক রাজনৈতিক বন্দীর মতো সেই নির্মম পরিণতি ভোগ করতে হয়নি মীর আহমেদ কাসেম আরমানকে। তিনি জানান, তাঁকে নিয়ে রাজধানী ঢাকার একপ্রান্তের একটি নির্জন মাঠে ফেলে রেখে চলে যায় নিরাপত্তারক্ষীরা।

মীর আহমেদ কাসেম আরমানকে ২০১৬ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তুলে নিয়ে যায়, যদিও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল না। দৃশ্যত, তিনি ছিলেন ইসলামি আন্দোলনের কর্মী এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী (মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মীর কাসেম আলী) এর ছেলে—এ কারণেই তাঁকে আটক রাখা হয়েছিল।

৪০ বছর বয়সী আরমান বলেন, দীর্ঘ অন্ধকার বন্দিজীবনে একমাত্র যে বিষয়টি তাঁকে পাগল হওয়া থেকে রক্ষা করেছে, তা হলো তাঁর স্ত্রী এবং দুই কন্যার (বর্তমানে ১১ ও ১২ বছর বয়সী) প্রতি চিন্তা। তিনি বলেন, ‘আমি সবসময় স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করেছি, যদি এ পৃথিবীতে আমাদের আর দেখা না হয়, অন্তত বেহেশতে যেন আমরা একত্র হতে পারি।’

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বরখাস্ত) আবদুল্লাহিল আমান আজমি।ছবি সংগৃহীত

‘৪১ হাজারবার চোখ বাঁধা ও হাতকড়া পরানো হয়’

আবদুল্লাহিল আমান আজমি গোপন বন্দিশালায় কাটানো তাঁর নিরন্তর যন্ত্রণা এবং অমানবিকতার বর্ণনা দিয়েছেন।

সাবেক উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা আমান আজমিকেও মূলত তাঁর বাবার কারণে (বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রয়াত আমির গোলাম আজম) আটক করা হয়েছিল। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর তিনি আয়নাঘর থেকে মুক্তি পান।

আমান আজমি আট বছর ধরে বন্দী ছিলেন। তাঁর অনুমান অনুযায়ী, এই সময়ের মধ্যে অন্তত ৪১ হাজারবার তাঁর চোখ বাঁধা এবং হাতকড়া পরানো হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমি বন্দিজীবনে সৃষ্টিকর্তার আকাশ, চাঁদ, সূর্য, ঘাস বা গাছপালা দেখতে পাইনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রথম দিকে দুটি ছোট ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে সূর্যের আলো দেখার চেষ্টা করতাম, কিন্তু সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়ার পর সেগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়।’

কারাগারে জীবনধারণের মতো কোনো পরিবেশ ছিল না, অথচ কঠোর নজরদারির মধ্যে শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়মিত করা হতো। প্রতি চার থেকে ছয় মাসে একবার চুল কাটা হতো। শারীরিক নির্যাতন বেশি চলত বন্দিজীবনের শুরুর দিকে, কিন্তু মানসিক নির্যাতন ছিল প্রায় অবিরত।

সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান।ছবি: সংগৃহীত

‘প্রতি শুক্রবার ভেসে আসত বাচ্চাদের গানের সুর’

মারুফ জামান কাতার ও ভিয়েতনামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং ২০১৯ সালে আয়নাঘর থেকে মুক্তি পান। এর আগে তিনি এই বন্দিশালায় এক বছরের বেশি সময় (৪৬৭ দিন) কাটান।

আয়নাঘরের ছবি আঁকার জন্য দ্য টাইমসের অনুরোধে মারুফ জামান গুগল ম্যাপ খুলে দেখান। জুম করলে দেখা যায়, ঢাকার একটি সামরিক ঘাঁটিতে আয়নাঘরের অবস্থান। এ গোপন বন্দিশালার নাম প্রথমবার জানা যায় ২০২২ সালে বিদেশে বাংলাদেশি গণমাধ্যম নেত্র নিউজের একটি প্রতিবেদনে।

মারুফ জামান ও মুক্তিপ্রাপ্ত অন্য বন্দীরা জানান, তাঁরা বন্দী অবস্থায় বুঝতে পেরেছিলেন যে, তারা একটি সামরিক ঘাঁটিতে আছেন। কারণ, ভোরবেলায় সেখানে কুচকাওয়াজের শব্দ শুনতেন। তাঁরা জানতেন যে, ধারেকাছেই কর্মকর্তাদের আবাসিক ভবন আছে এবং সেখানকার জীবনযাত্রা স্বাভাবিক। সেখান থেকে প্রতি শুক্রবার ভেসে আসত বাচ্চাদের গানের সুর।

মারুফ জামান শেখ হাসিনার কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে ভারতীয় স্বার্থরক্ষার বিষয়ে সমালোচনা করতেন। আয়নাঘরে জিজ্ঞাসাবাদকালে তাঁর মুখে অনবরত ঘুষি মারা হতো, যার ফলে তিনি দুটি দাঁত হারান। জিজ্ঞাসাবাদকারীরা তাঁর সামনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ব্লগে নিজের দেওয়া সব পোস্ট প্রিন্ট করে নিয়ে আসতেন এবং পোস্টগুলোর নির্দিষ্ট কিছু প্যারার বিষয়ে তাঁকে জেরা করতেন।

একদিন, জিজ্ঞাসাবাদকারীদের একজন জামানকে বলেছিলেন, ‘আপনার পোস্ট প্রিন্ট করতে আমরা অনেক অর্থ খরচ করেছি। আপনার বাবা কি এসব অর্থ আমাদের ফেরত দেবেন?’

মাইকেল চাকমা

‘পাঁচ বছরের মধ্যে প্রথম দিনের আলো দেখলাম’

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অধিকারকর্মী মাইকেল চাকমা। আগস্টের একটি দিন, তাঁকে চোখ বাঁধা অবস্থায় কয়েক ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে একটি জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হয়।

মাইকেল চাকমা বলেন, ‘পাঁচ বছরের মধ্যে এই প্রথম আমি দিনের আলো দেখলাম। যখন দেখছিলাম, দুবার পরীক্ষা করছিলাম, আমি কি এই আলো স্বপ্নে দেখছি, নাকি বাস্তবেই।’

২০১৯ সালে ঢাকায় একটি ব্যাংকে ঢোকার পর অপহৃত হন মাইকেল চাকমা। কারাগারের ভেতর তিনি জিজ্ঞাসাবাদকারীদের কাছে জানতে চাইতেন, কেন তাঁকে সেখানে রাখা হয়েছে। সবচেয়ে কাছাকাছি যে জবাব তিনি পেয়েছেন, তা হলো—রাজনৈতিক প্রতিশোধ।

সাবেক বন্দীদের তিনজনের কাছে আয়নাঘরের একটি ছবি আঁকতে অনুরোধ জানিয়েছিল দ্য টাইমস। তাঁদের আঁকা স্কেচে দেখা যায়, একটি লম্বা করিডর, যেখানে আধা ডজন কক্ষ রয়েছে। কক্ষগুলো একটি অপরটির থেকে দূরে, তবে মুখোমুখি অবস্থায় রয়েছে। করিডরের দুই প্রান্তে শৌচাগার রয়েছে—একটি দাঁড়িয়ে ব্যবহারের জন্য এবং অন্যটি বসার জন্য। প্রতিটি কক্ষে একটি বড় এগজস্ট ফ্যান ছিল, যা নিরাপত্তারক্ষীদের আলাপ শোনার জন্য নয় এবং বন্দীদের মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত করে তোলার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হত।

প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে শেখ হাসিনা নিজের দল আওয়ামী লীগের একটি সমাবেশে অংশ নিতে চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন। ওই সময় মাইকেল চাকমার দলীয় ছাত্রসংগঠন সড়ক অবরোধ করেছিল। প্রধানমন্ত্রী সমাবেশে বক্তৃতা শেষ করতে গিয়ে হুমকি দেন, বলেছিলেন, এ বিক্ষোভের পেছনে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের তিনি দেখে নেবেন।

মাইকেল চাকমা জানান, ওই ঘটনার পর শেখ হাসিনা তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তিনি আরও বলেন, ‘আমি সব সময় তাঁদের কাছে জানতে চাইতাম, আমার কী অপরাধ? আমি কী করেছি? আমি কি দোষী? তাঁরা বলতেন, আমি আওয়ামী লীগ সরকারকে নিয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে রাজনীতি করছি।’

এছাড়া, সাবেক সেনাকর্মকর্তা আজমি সাক্ষাৎকারে আয়নাঘরে চালানো নির্যাতন প্রসঙ্গে দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, বড় কাপড় দিয়ে কখনো কখনো তাঁর চোখ এমনভাবে বাঁধা হতো যে নাক আটকে শ্বাস নিতে কষ্ট হতো। এতে চোখে ব্যথা লাগত। আবদ্ধ ঘরে থাকার ফলে তাঁর দাঁত ক্ষয়ে গেছে এবং ত্বকে ঘা দেখা দিয়েছে।

আজমি জানান, এতসব নির্যাতনের মাঝেও সারাক্ষণ একটি আতঙ্ক তাঁকে তাড়া করে বেড়াত। তিনি বলেন, ‘মনে হতো, একদিন রাতে আমাকে বাইরে নিয়ে হত্যা করা হবে, এবং পরদিন পত্রিকার পাতায় বলা হবে, পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছি।’

তিনি সৃষ্টিকর্তার কাছে মনেপ্রাণে প্রার্থনা করতেন, যেন তাঁর মরদেহ কুকুর-বিড়ালে খেয়ে না ফেলে। বরং, মরদেহ যেন তাঁর পরিবার ও স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

এক সংবাদ সম্মেলনে আজমি বলেছেন, ‘যে অপমান ও যন্ত্রণা আমি ভোগ করেছি, তা কোনো ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়।’

আইনজীবী আরমানকে ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে তাঁর স্ত্রী এবং চার বছর বয়সী কন্যার সামনে থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। আপাতদৃষ্টে, এমন কাজের জন্য তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, যার সঙ্গে তিনি কোনোভাবেই যুক্ত ছিলেন না।

আরমানকে আটক করা হয়েছিল তাঁর বাবা মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার কিছুদিন আগে। হাসিনা সরকার তাঁকে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করেছিল। ১৯৭১ সালে মীর কাসেম আলী ছিলেন জামায়াতে ইসলামী দলের একজন কিশোর বয়সী ছাত্রনেতা, যা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল।

ব্যাংক, গণমাধ্যম এবং হাসপাতালের মালিক মীর কাসেম আলীকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের জন্য একটি হুমকি হিসেবে দেখতেন।

“পাঁচ বছরের মধ্যে এই প্রথম আমি দিনের আলো দেখলাম। যখন দেখছিলাম, আমি দুবার পরীক্ষা করছিলাম, আমি কি এ আলো স্বপ্নে দেখছি, নাকি এটি বাস্তব।”
— মাইকেল চাকমা, আয়নাঘর থেকে মুক্তি পাওয়া অধিকারকর্মী

আরমান বলেন, “আমি বাবার একাত্তরের ভূমিকার জন্য গর্বিত নই।” তবে তিনি দাবি করেন, তাঁর বাবা এক দিনের জন্যও কারাগারে থাকার উপযুক্ত ব্যক্তি ছিলেন না; আর মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য তো ননই।

বছরের পর বছর যন্ত্রণা ও অনিশ্চয়তা কাটিয়ে শেষমেশ আরমান তাঁর স্ত্রী, দুই কন্যা ও মায়ের সঙ্গে আবার একত্র হতে পেরেছেন। এর আগে তাঁকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। তবে বাবাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া, জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় হারিয়ে যাওয়া এবং নিঃসঙ্গ বন্দিজীবন কাটানোর কারণে জীবনকে বিধ্বস্ত করে দেওয়া এসব ঘটনা তাঁকে সবসময় তাড়া করে বেড়ায়।

ডিজিএফআই সদর দপ্তরের যাওয়ার কথা জানিয়ে ফেসবুকে দেওয়া পোস্টের সঙ্গে এই ছবিটি যুক্ত করেন পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা শহিদুল আলম।ছবি : শহিদুল আলমের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে নেওয়া

ন্যায়বিচারের সন্ধানে

শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর নারী-পুরুষের একটি ছোট দল লাখো উল্লসিত জনতার ঢেউ ঠেলে সেনা সদর দপ্তরের ফটকে হাজির হয়েছিল।

এই দলে ছিলেন এমন কিছু ব্যক্তি, যাঁরা হাসিনার আমলে জোরপূর্বক গুমের শিকার হয়েও বেঁচে ফিরেছেন। তাঁদের একজন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসিনুর রহমান, যিনি দেড় বছর নিখোঁজ ছিলেন। এই সাবেক সেনা কর্মকর্তা আয়নাঘর প্রসঙ্গে বলেন, “আমরা দিন-রাত ঘুমাতে পারতাম না। লোকজন কাঁদত, চিৎকার করত, তাঁদের নির্যাতন করা হতো।”

ফটকে হাজির হওয়া নারীরা খুঁজছিলেন তাঁদের হারানো স্বজনদের। বহু বছর ধরে তাঁরা দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন, স্বজনের সন্ধানে। যদিও জীবিত না পেলেও, মরদেহের সন্ধানটুকু পেতে চান।

এ ঘটনার পর কয়েক দিনের মধ্যে ফিরে এসেছেন আরমান, আজমি ও মাইকেল চাকমা। তাঁদের মুক্তি গুমের শিকার অন্য ব্যক্তিদের মা, বোন, স্ত্রী ও কন্যাদের মনে নতুন আশা জুগিয়েছে।

ঢাকা সেনা সদর দপ্তরের মতোই দেশের অন্যান্য অংশের বিভিন্ন সেনাঘাঁটির বাইরে হারানো স্বজনদের খোঁজে ভিড় করেছিলেন অনেকে। তাঁদের সবার প্রশ্ন, “আমাদের প্রিয় মানুষ কোথায়?” স্বজন হারানো এসব ব্যক্তি যেখানেই সমবেত হন না কেন, তাঁদের একটাই দাবি, “বন্ধ করা হোক এসব আয়নাঘর।”

দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন

Check out our other content

Check out other tags:

'এই অ্যাপের মাধ্যমে অভিযুক্তরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে এক মাসে ৩০ থেকে ৯০ শতাংশ দৈনিক এক থেকে পাঁচ শতাংশ রিটার্নের গ্যারান্টি রয়েছে। হাইবক্স কেলেঙ্কারি কীভাবে কাজ করেছিল প্রসঙ্গত‘সাতক্ষীরাসহ সারা দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রয়েছে। সাতক্ষীরা জেলাকে নিয়ে আগে যে কথা শোনা হতো‘হাইবক্স একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন যা একটি সুপরিকল্পিত কেলেঙ্কারির অংশ ছিল’। পুলিশ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে“আমি যে দুটি মন্ত্রণালয়ে আছি“দেশের মেরিন একাডেমিগুলোর আধুনিকায়ন এবং এখান থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের বৈশ্বিক নৌ সেক্টরে যুক্ত করার জন্য সরকারের সদিচ্ছা রয়েছে।” এ সময় বরিশাল সেনানিবাসের জিওসি মেজর জেনারেল আবদুল কাইয়ুম মোল্লা

Most Popular Articles