দিনে সঞ্চালন সক্ষমতা ৫০০ কোটি ঘনফুট।
দিনে সরবরাহ করছে ২০০ কোটি ঘনফুট।
২০২২-২৩ অর্থবছরে ক্ষতি ১২১২ কোটি টাকা।
দেশে কয়েক বছর ধরে গ্যাস সরবরাহের সংকট বাড়ছে। তবু রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে খুলনা ও রাজশাহীতে নেওয়া হয়েছে গ্যাসের পাইপলাইন। তবে নতুন সংযোগ হয়েছে হাতে গোনা। রংপুরে নেওয়া হচ্ছে নতুন লাইন। যদিও গ্যাস কবে যাবে, তার নিশ্চয়তা নেই। হাজার হাজার কোটি টাকায় গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ করে লোকসানে ডুবছে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)।
জিটিসিএল সূত্র বলছে, দেশের মোট গ্যাস সরবরাহের ৭৫ শতাংশ সঞ্চালন করে জিটিসিএল। পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ হলে সঞ্চালন চার্জ পায় জিটিসিএল, এটিই তাদের আয়ের একমাত্র উৎস। গ্যাস সরবরাহ কমলে আয়ও কমে যায়। দিনে তাদের গ্যাস সঞ্চালন সক্ষমতা ৫০০ কোটি ঘনফুট। তারা সরবরাহ করে ২০০ কোটি ঘনফুট। অর্ধেকের বেশি সক্ষমতা থাকছে অব্যবহৃত।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সিদ্ধান্তে একের পর এক পাইপলাইন নির্মাণ করে এখন লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে জিটিসিএল। কোম্পানির দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এসব প্রকল্পে দাতা সংস্থা ও সরকারের পাশাপাশি জিটিসিএলের নিজস্ব অর্থায়ন আছে। এসব বিনিয়োগ করে আর্থিক চাপে পড়েছে সংস্থাটি। ঋণের কিস্তি শোধের চাপের মধ্যে কমছে সংস্থাটির আয়।
১৯৯৩ সালের ৪ ডিসেম্বর কোম্পানি নিবন্ধন নিয়ে যাত্রা শুরু করে জিটিসিএল। ওই সময় সঞ্চালন লাইন ছিল ৫৪৪ কিলোমিটার। ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে এটি দাঁড়ায় ২ হাজার ১৬৭ কিলোমিটারে।
২০২০-২১ অর্থবছরেও ৭৪ কোটি টাকা মুনাফা করেছে সংস্থাটি। এরপর ২০২১-২২ অর্থবছরে ২১৭ কোটি টাকা লোকসান গোনে। আগের বছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১১ শতাংশ গ্যাস সঞ্চালন কমেছে সংস্থাটির।
ওই অর্থবছরে সংস্থাটি লোকসান করেছে ১ হাজার ২১২ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে জিটিসিএলের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূখসানা নাজমা ইছহাক বলেন, ‘প্রকল্পসমূহ মূলধনীকরণের ফলে ঋণের সুদ ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপর দিকে অবচয় বৃদ্ধি এবং সিস্টেম লস অন্তর্ভুক্ত করার কারণে কোম্পানির ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের জন্য দুটি সঞ্চালন লাইন তৈরি করতে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে। সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল থেকে পাবনার ঈশ্বরদী হয়ে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা গেছে পাইপলাইন। আরেকটি প্রকল্পের অধীনে ভেড়ামারা থেকে খুলনায় নেওয়া হয়েছে গ্যাসলাইন। এরপর গ্রাহকের কাছে পৌঁছাতে আলাদা করে আবার বিতরণ পাইপলাইন করেছে সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি। গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত না করেই খুলনায় ৮০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার গ্যাসচালিত একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। কাজ প্রায় শেষের দিকে।
দেড় দশকে গ্যাস যায়নি খুলনায়
খুলনা, বরিশাল ও ঢাকা বিভাগের কয়েকটি জেলা নিয়ে ২০০৯ সালে গঠন করা হয় সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি। ১৪৪ কিলোমিটার বিতরণ পাইপলাইন আছে তাদের। ২০১২-১৩ থেকে শুরু করে গত বছর পর্যন্ত তারা সংযোগ দিয়েছে ২ হাজার ৩৯৩টি, যার মধ্যে আবাসিক সংযোগ ২ হাজার ৩৭৬টি। ১১ বছরে শিল্প সংযোগ হয়েছে মাত্র ৮টি। কুষ্টিয়ার তিনটি কারখানা ছাড়া সব সংযোগ হয়েছে ভোলায়। খুলনা ও বরিশালে কোনো সংযোগ হয়নি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আবাসিকে গ্যাস–সংযোগ বন্ধ প্রায় এক দশক ধরে। শিল্পেও সংযোগ হয় বিশেষ বিবেচনায়। গ্যাসের অভাবে ধুঁকছে শিল্পকারখানা। তবু অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে করা হয়েছে গ্যাস সরবরাহের পাইপলাইন। গ্যাস পাইপলাইন অব্যবহৃত থাকার কথা স্বীকার করেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্রনাথ সরকার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এসব পাইপলাইন প্রকল্প করা হয়েছে অনেক আগে।
ওই সময় গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তা এগোয়নি। কূপ খনন করে উৎপাদন বাড়ানো গেলে গ্যাস সরবরাহ দেওয়া যেত। মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে ইতিমধ্যে। প্রকল্পের খরচ ১ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। সৈয়দপুর পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ করার জন্য এ পাইপলাইন এখন তৈরি আছে। এখন মিটারিং স্টেশনের কাজ চলছে।
এর আগে রাজশাহী পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে গ্যাসলাইন। সংযোগ হচ্ছে হাতে গোনা উত্তরের জনপদে আর্থসামাজিক উন্নতি করার নামে ২০১৮ সালে নেওয়া হয় বগুড়া-রংপুর-সৈয়দপুর গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন প্রকল্প। ২০২৩ সালের জুনে এটি শেষ হওয়ার কথা। মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে ইতিমধ্যে। প্রকল্পের খরচ ১ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। সৈয়দপুর পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ করার জন্য এ পাইপলাইন এখন তৈরি আছে। এখন মিটারিং স্টেশনের কাজ চলছে।
এর আগে রাজশাহী পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে গ্যাসলাইন। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে গ্রাহকের কাছে গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি। গত ৮ বছরে মাত্র ১০৮টি গ্যাস সংযোগ দিয়েছে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি।
এর মধ্যে বিশেষ বিবেচনায় ৩৪টি আবাসিক সংযোগ দেওয়া হয়েছে। ২০০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তাদের মোট সংযোগ ১ লাখ ২৯ হাজার ৪১১টি। এর মধ্যে ১ লাখ ২৮ হাজার ৮৫২টি আবাসিক সংযোগ। মোট পাইপলাইন আছে ১ হাজার ৬৮৫ কিলোমিটার।
‘বাজে বিনিয়োগ, রুগ্ণ প্রকল্প’ দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। সরবরাহ করা হয় সর্বোচ্চ ৩০০ থেকে ৩১০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে দেশীয় উৎস থেকে আসে ২০০ কোটি ঘনফুট। আর তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে আসে ১১০ কোটি ঘনফুট। শিগগিরই দেশীয় উৎস থেকে উৎপাদন বাড়ার সম্ভাবনা কম। তাই এলএনজি আমদানি বাড়াতে নানা পরিকল্পনা নিয়েছিল গত আওয়ামী লীগ সরকার। আমদানি চুক্তির পাশাপাশি নতুন টার্মিনাল নির্মাণেও চুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়। নতুন প্রকল্পের মধ্যে পায়রা-বরিশাল-গোপালগঞ্জ পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় হতে পারে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। পায়রায় নির্মিত হতে যাওয়া এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ করতে এ পাইপলাইন নির্মাণ করার কথা। এ ছাড়া দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের জন্য নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দ থেকে মাওয়া হয়ে জাজিরা-টেকেরহাট-গোপালগঞ্জ পাইপলাইনে খরচ ধরা হয়েছে ২ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। এসব প্রকল্পের বিষয়ে নতুন করে ভাবছে সরকার। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, খুলনা ও রাজশাহীতে যখন পাইপলাইন নেওয়া হয়, তখন থেকেই গ্যাস-সংকট ছিল। এসব প্রকল্পে রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করেছে। এগুলো বাজে বিনিয়োগ, রুগ্ণ প্রকল্প। রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ থেকে সরকারের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় এসব পাইপলাইন করা হয়েছে।
‘বাজে বিনিয়োগ, রুগ্ণ প্রকল্প’
দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। সরবরাহ করা হয় সর্বোচ্চ ৩০০ থেকে ৩১০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে দেশীয় উৎস থেকে আসে ২০০ কোটি ঘনফুট। আর তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে আসে ১১০ কোটি ঘনফুট। শিগগিরই দেশীয় উৎস থেকে উৎপাদন বাড়ার সম্ভাবনা কম।
তাই এলএনজি আমদানি বাড়াতে নানা পরিকল্পনা নিয়েছিল গত আওয়ামী লীগ সরকার। আমদানি চুক্তির পাশাপাশি নতুন টার্মিনাল নির্মাণেও চুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়। নতুন প্রকল্পের মধ্যে পায়রা-বরিশাল-গোপালগঞ্জ পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় হতে পারে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা।
পায়রায় নির্মিত হতে যাওয়া এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ করতে এ পাইপলাইন নির্মাণ করার কথা। এ ছাড়া দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের জন্য নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দ থেকে মাওয়া হয়ে জাজিরা-টেকেরহাট-গোপালগঞ্জ পাইপলাইনে খরচ ধরা হয়েছে ২ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। এসব প্রকল্পের বিষয়ে নতুন করে ভাবছে সরকার।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, খুলনা ও রাজশাহীতে যখন পাইপলাইন নেওয়া হয়, তখন থেকেই গ্যাস-সংকট ছিল। এসব প্রকল্পে রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করেছে। এগুলো বাজে বিনিয়োগ, রুগ্ণ প্রকল্প। রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ থেকে সরকারের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় এসব পাইপলাইন করা হয়েছে।