ফ্লিক–লেভার কাঁধে বন্দুক, পৃথিবী তখন পার করছিল ঘোর মহামারিকাল। করোনা মহামারি নামের এক ব্যাধি পৃথিবীর বুকে কায়েম করেছিল ভয়াবহ এক ত্রাসের রাজত্ব। অন্য সবকিছুর মতো ফুটবলও সে সময় মহামারির কবলে পড়ে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু করপোরেট পুঁজি আর পণ্যায়নের যুগে মহামারিকেও একসময় হার মানতে হয়।
দর্শকশূন্য স্টেডিয়ামে বিশেষ নিয়ম মেনে শুরু হয় ফুটবল। তেমন একসময়ে ২০২০ সালের ১৪ আগস্ট চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলতে পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে গিয়ে হাজির হয়েছিল বায়ার্ন মিউনিখ ও বার্সেলোনা। বন্ধ গ্যালারিতে দুই সমশক্তির দলের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দেখতে অপেক্ষায় ছিলেন ফুটবলপ্রেমীরাও।
লিসবনে অবশ্য এ ম্যাচ ঘিরে খুব একটা উত্তাপ ছিল না। একে তো নিরপেক্ষ মাঠে খেলা, তার ওপর গ্যালারিতে বসার সুযোগ নেই। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছিলেন, এত বড় ম্যাচ আয়োজনের পরও আশপাশে খেলার কোনো চিহ্ন ছিল না! ম্যাচ ঘিরে মূল উত্তাপটা ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
বার্সা সমর্থকেরাও ঢাল–তলোয়ার নিয়ে ভার্চ্যুয়াল লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু ম্যাচ শুরুর আগেই বার্সার জন্য উল্টো দিক থেকে বাতাস বইতে শুরু করে। ম্যাচের আগে প্রকৃতিও নানাভাবে বিপৎসংকেত পাঠিয়েছিল বার্সাকে। সেসব যে তারা আমলে নেয়নি, ম্যাচের ফলেই তা স্পষ্ট।
মাঠে নামার আগেই বার্সা জানতে পারে চোটের কারণে স্পেনে রেখে আসা ডিফেন্ডার স্যামুয়েল উমতিতি করোনায় আক্রান্ত। সেই করোনাভীতিই হয়তো ম্যাচের আগে মনোবল ভেঙে দিয়েছিল লিওনেল মেসি–লুইস সুয়ারেজদের। যদিও এসব বিষয়কে কেউ চাইলে খোঁড়া যুক্তি হিসেবে উড়িয়ে দিতে পারেন। বাস্তবিক অর্থে সেদিন বার্সার সঙ্গে যা ঘটেছিল, তা ব্যাখ্যাতীত।
সেদিন যা ঘটেছিল, তা হয়তো এখনো বার্সা সমর্থকদের দুঃস্বপ্নে হাজির হয়। বায়ার্নের বিপক্ষে সেমিফাইনালে যাওয়ার সে ম্যাচে বার্সা বিধ্বস্ত হয়েছিল ৮–২ গোলে। ম্যাচ শেষে বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যমের ম্যাচ প্রতিবেদনে একটি শব্দ ছিল—‘অবিশ্বাস্য’। এমনকি সেদিন যাঁরা ম্যাচ না দেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, পরদিন তাঁরাও চোখ কচলে বারবার ফলটা যাচাই করে দেখেছেন। মনের কিংবা চোখের ভুল না তো! এমনও কি হয় নাকি? বার্সার তো আর পাড়ার কোনো দল নয় যে ৮ গোল হজম করবে!
শেষ পর্যন্ত অবশ্য এই ফল ছিল নির্মম এক বাস্তবতা। এখনো বার্সাকে ঘায়েল করার জন্য স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় সেই ম্যাচের কথা। বরাবরের মতো আজও বার্সা–বায়ার্নের ম্যাচের আগেও ফিরে আসছে সেই ম্যাচের স্মৃতি। তবে এবার ভিন্ন রকম চমকও আছে। যাঁর ‘মাস্টারপ্ল্যানে’ সেদিন বার্সা বিধ্বস্ত হয়েছিল, সেই হান্সি ফ্লিক আজ রাতে কাতালান ক্লাবটির ডাগআউটেই দাঁড়াবেন। যেখানে সেই ম্যাচে বায়ার্নের হয়ে খেলা আরও একজনকে নিজেদের সঙ্গে পাচ্ছে বার্সা, রবার্ট লেভানডফস্কি। বায়ার্নের সাবেক এই ‘বন্দুক’ দিয়েই বার্সা এখন জার্মান ক্লাবটির ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার অপেক্ষায়। বার্সার জন্য আরেকটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে ম্যাচটি তারা খেলবে নিজেদের ঘরের মাঠ অলিম্পিক লুইস কোম্পানি স্টেডিয়ামে।
ফ্লিক–লেভা ছাড়াও চার বছর আগের সেই গোল উৎসবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন টমাস মুলার। জোড়া গোল করার পাশাপাশি অসাধারণ নৈপুণ্য উপহার দিয়েছিলেন এই জার্মান স্ট্রাইকার। আর বার্সার জন্য ঘরের শত্রু বিভীষণ হয়ে ধরা দিয়েছিলেন ফিলিপে কুতিনিও। বার্সা থেকে ধারে বায়ার্নে যোগ দেওয়া এই ব্রাজিলিয়ানও সেদিন করেন জোড়া গোল। দুই অর্ধে ৪টি করে গোল করে সেই ম্যাচে ৮ গোলের কোটা পূরণ করেছিল বাভারিয়ান ক্লাবটি।
সেই ম্যাচ নিয়ে পরে বার্সার সাবেক পরিচালক হাভিয়ার ভিলাজোয়ানা বলেছিলেন, ‘আমরা একটা নিখুঁত ঝড়ের মাঝখানে ছিলাম—‘মহামারি, অর্থনৈতিক সংকট এবং মেসির অবস্থাও ভালো ছিল না। আর যখন শুরু থেকেই সবকিছুই ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছিল, দলও হাল ছেড়ে দেয়। আর বায়ার্নের মতো একটি শক্তিশালী দলের বিপক্ষে এমন কিছুর দায়ও আপনাকে শোধ করতে হয়।’ ম্যাচের পর বার্সার খেলোয়াড়েরা নাকি এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে পরবর্তী এক বছরেও সেই যন্ত্রণা থেকে বেরোতে পারেননি।
সেবার পর্তুগালে যাওয়ার আগে থেকেই যে বাতাস তার গতিপথ বদলাচ্ছিল, সেটা নাকি বুঝতে পেরেছিলেন অনেকেই। সিনিয়র আরেক কর্মকর্তার দাবি অনুযায়ী, ক্লাবটি তখন অনেক ধরনের সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। বিশেষ করে মেসির ভবিষ্যৎ এবং কোচ কিকে সেতিয়েনের সঙ্গে খেলোয়াড়দের মানিয়ে নিতে না–পারা দলকে বাজে পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
ফলে দল ঠিকঠাক প্রস্তুত হয়ে লিসবনে যেতে পারেনি। এর খেসারত? ১৯৪৬ সালের পর যা ছিল বার্সার সবচেয়ে বড় হার। কে জানে, ৭৪ বছর পর বার্সায় ফিরে আসা দুঃসহ সেই স্মৃতি মেসিকে এখনো তাড়া করে কি না? নিজের অসামান্য সব কীর্তির ভিড়ে ‘চাঁদের কলঙ্ক’–এর মতো যে কটি দাগ মেসির ক্যারিয়ারে আছে এই হারটি তার অন্যতম।
প্রশ্ন হচ্ছে, সেই হারের দাগ ফ্লিকের কাঁধে বন্দুক রেখে বার্সা ভুলতে পারবে কি? ৮ বা তার কাছাকাছি গোলে হারানোটা অবশ্য কষ্টকল্পনার মতো ব্যাপার। এমন কিছু তো আর প্রতিদিন হয় না। ফলে সেসব ভাবনা অলৌকিকের হাতে ছেড়ে দেওয়ায় ভালো। তবে বড় জয়ের কথা তো চাইলে ভাবাই যায়। ফ্লিকের অধীনের এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি বড় জয় দেখেছে বার্সা। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে শেষ তিন ম্যাচে বার্সা গোল করেছে ১৩টি। বিপরীতে হজম করেছে মাত্র ১ গোল।
সর্বশেষ লা লিগায় সেভিয়ার বিপক্ষে বার্সা জিতেছে ৫–১ গোলে। বার্সার হয়ে দারুণ ছন্দে আছেন লামিনে ইয়ামাল–রবার্ট লেভানডফস্কি–রাফিনিয়ারা। বিশেষত ইয়ামাল ও লেভা আছেন সেরা ছন্দে। একই সঙ্গে চোট কাটিয়ে গাভির ফেরাও বার্সাকে নতুন করে সাহস জোগাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বায়ার্ন যতই শক্তি নিয়ে আসুক, বার্সা নিজেদের স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে পারে বড় জয় মোটেই অসম্ভব কিছু নয়। আর সাবেক কোচ হওয়ায় বায়ার্নের হাঁড়ির খবর ফ্লিকের জানা আছে। ফলে ভিনসেন্ট কোম্পানির দলকে থামানোর ছকটা ঠিকঠাক কষেই যে তিনি দলকে মাঠে নামাবেন, তা বলা বাহুল্য।
গুরুত্বপূর্ণ এই ম্যাচে বায়ার্নও নিশ্চয়ই ছেড়ে কথা বলবে না। বেলজিয়ান কোচ কোম্পানির অধীনে দলটি এখন নিজেদের সেরা সময় ফিরে পাওয়ার অপেক্ষায়। ৭ ম্যাচ শেষে বুন্দেসলিগায় শীর্ষে বায়ার্ন। চ্যাম্পিয়নস লিগে অবশ্য অম্লমধুর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছে বায়ার্ন।
প্রথম ম্যাচে দিনামো জাগরেবের বিপক্ষে ৯–২ গোলে জিতলেও পরের ম্যাচে অ্যাস্টন ভিলার কাছে ১–০ গোলে হেরে ধাক্কা খেয়েছে তারা। এখন বার্সার বিপক্ষে বায়ার্নের চ্যালেঞ্জটা ঘুরে দাঁড়ানোর। তবে বায়ার্ন চাইলে বার্সার বিপক্ষে মুখোমুখি হওয়ার পরিসংখ্যান থেকেও অনুপ্রেরণা নিতে পারে। চ্যাম্পিয়নস লিগে ১৩ ম্যাচে মুখোমুখি হয়ে বায়ার্নের ১০ জয়ের বিপরীতে বার্সা জিতেছে মাত্র ২ ম্যাচ। অন্য ম্যাচটি ড্র।
ফুটবলে পরিসংখ্যান কারও কারও চোখে অবশ্য ভারবাহী গাধা। আর অতীতকে বলা যায় বিষণ্ন ভাগাড়। এখান থেকে অনুপ্রেরণাই যা একটু পাওয়া যায়। এর বাইরে বাকিটা মাঠে খেলেই জিততে হয়। আজও সব অতীত ও পরিসংখ্যান ভুলে মাঠের লড়াইয়েই শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিতে হবে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা দুই ক্লাবকে।
সুত্র: প্রথম আলো