আজ থেকে মাস পাঁচেক আগে অনেকটা চাপে পড়ে মাসিক ৫০০ টাকা হারে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির সমতা স্কিমের আওতায় স্ত্রীর নামে নিবন্ধন করেছিলেন মো. সোহেল খান। কিন্তু হিসাব খুললেও তিনি নিয়মিত চাঁদা দিতে আগ্রহী হননি।
সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি, বাংলাদেশের পটুয়াখালী জেলার একটি বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের এই শিক্ষক নিয়মিত চাঁদা প্রদান বিষয়ে বিবিসি বাংলাকে বলেন, বাধ্যতামূলভাবে অ্যাকাউন্ট খোলার মতো সরকার যদি এখন টাকা জমা দিতেও বাধ্য করে, তাহলে হয়তো তিনি ফের টাকা জমা দিবেন।
“কিন্তু তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে হবে না।”
মি. খানের মতো এরকম আরও বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলেছে বিবিসি বাংলা। তাদের অনেকেই একই কথা জানিয়েছেন এবং কেউ কেউ তাদের জমা টাকা নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন। কারণ শেষপর্যন্ত যখন পেনশন দরকার হবে, তখন তারা এই টাকা ফেরত পাবেন কিনা তা নিয়ে তাদের মধ্যে আশঙ্কা আছে। যদিও সরকারের তরফ থেকে এই বিষয়ে বারবার আশ্বাস দেয়া হয়েছে।
পেনশন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারাও জানিয়েছেন, প্রায় ২০ শতাংশ গ্রাহক তাদের চাঁদা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে এবং নতুন নিবন্ধনকারীর সংখ্যাও আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
উচ্চ আশা নিয়ে যাত্রা শুরু করা সর্বজনীন পেনশন প্রকল্পে মানুষের অনাগ্রহের কারণ কী? এটি কি তবে ব্যর্থ প্রকল্পে পরিণত হচ্ছে?
গ্রাহকদের শঙ্কা-অভিযোগ
পটুয়াখালীর শিক্ষক সোহেল খান মনে করেন, “ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইসিসকে ট্যাকল দেওয়ার জন্য একটা কানিং পলিসির মাধ্যমে” এই সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি শুরু হয়েছিলো।
শুরু থেকেই তিনি এখানে টাকা জমা রাখতে চাননি। কিন্তু, তাদেরকে জমা রাখতে বাধ্য করা হয়েছিলো।
“আমাদের যে বেতন কাঠামো, তা দিয়ে আমাদের চলতে-ফিরতে অনেক কষ্ট হয়। জীবনযাত্রার মান ধরে রাখতে গিয়ে প্রত্যেকে ঋণে জর্জরিত। আমাকে আগে খেয়ে-পরে তো বেঁচে থাকতে হবে।”
ফলে এই পেনশন স্কিমের প্রতি তিনি আগ্রহী নন।
গতকাল সোমবার, ১৪ই অক্টোবর অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের পরিচালনা পরিষদের একটি সভা হয়।
সেই সভা পরামর্শ দিয়েছে, গ্রাহকের মনের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য পেনশন কর্তৃপক্ষ যেন কাজ করে যায়। সেইসাথে, গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য “প্রয়োজনীয় পরিবর্তনও” নিতে বলেছে তারা।
এটা জানিয়ে মি. খানের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিলো যে গ্রাহকরা এখান থেকে নিশ্চিতভাবে লাভবান হবে, অন্তবর্তীকালীন সরকার এমন প্রতিশ্রুতি দিলে তিনি টাকা জমা দেওয়া শুরু করবেন কিনা।
তার উত্তর ছিল, “আমি কন্টিনিউ করবো না। প্রথমত, আমাদের স্কেল কম। সেইসাথে, জিনিসপত্রের যে দরদাম, তাতে আমার হাত থেকে টাকাটা চলে গেলে আমার চলাফেরা করাটাই মুশকিল হয়ে যায়।”
এ বিষয়ে কথা হয় ওই একই এলাকার আরও একজন শিক্ষকের সাথে। কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরুর কয়েকদিন আগে দুই হাজার টাকা দিয়ে নিবন্ধন করেছিলেন তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই শিক্ষক বলেন যে, তার নিবন্ধন করার কোনও ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু তিনি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কথায় বাধ্য হয়ে নিবন্ধন করেছিলেন। যদিও, পরবর্তীতে তিনিও আর কোনও টাকা জমা দেননি।
২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করা এই নারী শিক্ষক বলেন, “যোগদানের পর এখনও ইনক্রিমেন্টের টাকা দেয় নাই। এই অবস্থায় মাসে মাসে দুই হাজার টাকা জমা রাখলে আমার পক্ষে পরিবার চালানো কঠিন হয়ে যাবে। ১০ বছর পর কী হবে, সেটা ভেবে এখন টাকা রাখা সম্ভব না।”
এদিকে, এখনও নিবন্ধন করেননি, এমন কয়েকজনের সাথেও কথা হয় বিবিসি বাংলা’র। কিন্তু তারা প্রত্যেকে জানিয়েছেন, তাদের কেউ-ই সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচিতে “বিশ্বাসী না”।
তবে অর্থনীতিবিদ ও খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পেনশন স্কিম নিয়ে এই ধরনের জটিলতা যে হবে, তা অনেকেই আগে থেকে ধারণা করছিলেন।
অনেকের অভিযোগ রয়েছে, পেনশন স্কিমে একবার তালিকাভুক্ত হয়ে চাঁদা দেয়া শুরু করার পর জরুরি প্রয়োজনে সেটা ভেঙ্গে ফেলার সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের সরকারি সেবা ব্যবস্থা নিয়েও অনেকের অভিযোগ রয়েছে। এমনকি সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বিদ্যমান পেনশন পাওয়া নিয়েও অনেক ভোগান্তির অভিযোগ রয়েছে। ফলে যে সময়ের পর পেনশন দেয়ার কথা বলা হয়েছে, তখন ঝামেলাহীনভাবে এবং সহজে পেনশন পাওয়া যাবে কিনা, তা নিয়েও অনেকের মধ্যে সংশয় রয়েছে।
বিশ্বাস-আগ্রহ ফেরাতে বৈঠক
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আজ ১৫ই অক্টোবর পর্যন্ত মোট তিন লাখ ৭২ হাজার ১৫৫ জন গ্রাহক সর্বজনীন পেনশনের চার স্কিমে নিবন্ধন করেছেন।
কিন্তু এদের সিংহভাগই পুরাতন নিবন্ধনকারী এবং নতুন করে কেউ নিবন্ধন করেনি বললেই চলে।
তবে পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, “আগে এনরোলমেন্ট নিয়মিত ছিল। সরকার পরিবর্তনের পর আমরাও প্রচারে যেতে পারি নাই। তখন এনরোলমেন্ট কম হয়েছে।”
তাই, “গ্রাহকদের আকৃষ্ট করার জন্য পেনশন কর্তৃপক্ষকে পরামর্শও দিয়েছে বোর্ড। সময়ে সময়ে যদি কোনও পরিবর্তন আনার প্রয়োজন হয় তাহলে সেই সুযোগও আছে,” এমনটাই জানিয়েছেন তিনি।
কী ধরনের পরিবর্তন, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমাদের স্কিমের চাঁদার সাথে কোনও ইন্স্যুরেন্সের সংযোগ নাই, কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আছে। আমরা যদি দেখি যে এখানে ইন্সুরেন্স যোগ করা দরকার, এটা পেনশনারদের জন্য সুবিধাজনক ও পেনশনাররাও তা করতে চাচ্ছেন, বা এটা করলে গ্রাহক সংখ্যা বাড়বে– তখন আমরা এখানে পরিবর্তন আনতে পারি।”
“একজন শ্রমিক, তিনি দুর্ঘটনায় পড়লে তার তো চাঁদা দেওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। তাই, ইন্স্যুরেন্স থাকলে সে হয়তো সেখান থেকে ওই সুবিধাটা পাবে,” ব্যাখ্যা করেন তিনি।
পাশাপাশি, “বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পেনশন পাওয়ার বয়স বাড়ায়। এরকম পরিবর্তনও আসতে পারে।”
সর্বজনীন পেনশন স্কিম জনপ্রিয় করার জন্য প্রচারে মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন যে গত পাঁচই অগাস্টের পরে “পরিবেশ অনুকূলে না থাকায়” তারা “প্রচার নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে” ছিলেন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের থেকে আশ্বাস পেয়ে “আমরা আবার প্রচারে যাচ্ছি। বোর্ড বলেছে, এনরোলমেন্ট বাড়ানোর জন্য তোমরা যা যা করা দরকার, করো। সেই প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমরা সামনে আবার স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে রুট পর্যায়ে যাবো। ইতোমধ্যে আমরা বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু করেছি।”
“কয়েকদিন আগে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ হল, সেখানে আমরা আমাদের বিজ্ঞাপন দিয়েছি। ভবিষ্যতে আমরা নতুন নতুন জায়গায় বিজ্ঞাপন দিবো। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কর্মশালা ও মেলা করবো। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ইন্সিটিউটগুলোতে সেশন আয়োজনের চেষ্টা করবো,” ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নিয়ে বলছিলেন তিনি।
সরকারের পদক্ষেপ কাজে দেবে?
পেনশন কর্তৃপক্ষ তাদের পদক্ষেপের বিষয়ে আশাবাদী হলেও বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন যে এই পুরো কর্মসূচিকে ঘিরে কিছু দুর্বলতা রয়েছে। সেগুলোকে ঠিক না করা গেলে মানুষ খুব বেশি সাড়া দিবে না।
সেক্ষেত্রে, অনেক প্রকল্পের মতো এই প্রকল্পও সরকারের একটি ব্যর্থ প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত হবে।
গ্রাহকরা যে টাকা জমা দিচ্ছেন না বা কেউ নতুন করে খুব বেশি মানুষ পেনশন স্কিমে নিবন্ধন করছেন না, এ প্রসঙ্গে সাবেক এই অর্থনীতিবিদ বলেন যে বিগত সরকারের আমলে সর্বজননীন পেনশন কর্মসূচি চালু হওয়ার পর থেকেই “এই ধরনের একটা আশঙ্কা সবাই করছিলো”।
তিনি বলেন, কারণ, “এই স্কিম ব্যবস্থাপনার নকশা যেভাবে করা হয়েছে, সেটাতে দুর্বলতা আছে। এখানে ক্যাশ ম্যানেজমেন্ট কিভাবে হচ্ছে, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি। এটাকে বসানো হয়েছে ফাইন্যান্স বিভাগে।”
“আজকে আমি টাকা দিচ্ছি, এই টাকা ফেরত পাবো ৬০ বছর পরে। তো, আজ যে কর্তৃপক্ষকে আমি টাকা দিচ্ছি, ওই সময়ে সেই কর্তৃপক্ষ কী অবস্থায় থাকবে? এখন তো কাজটা সহজ। আপনি টাকা আদায় করছেন। টাকা দেওয়ার কোনও বোঝা নাই। অন্তত এক দশকের বেশি সময় এটাই থাকবে।”
সেক্ষেত্রে, গ্রাহকদের মনে প্রশ্ন আসবে, “আমার টাকা নিয়ে তারা তা দিয়ে কী করছে?” বলছিলেন তিনি।
“এখানে মিসগভর্ন্যান্সের সুযোগ আছে কি না, টাকা সঠিকভাবে নিরাপদ জায়গায় বিনিয়োগ করা হচ্ছে কি না, টাকা দেওয়ার সময় এলে কর্তৃপক্ষের আর্থিক সক্ষমতা থাকবে কি না; এগুলোর উত্তর প্রয়োজন।”
মি. হোসেন আরও মনে করেন, সর্বজনীন পেনশন স্কিমে আস্থা ফেরাতে এটি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব “সরকারের বাইরে স্বাধীন স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানকে” এবং “দক্ষ, ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট বুঝেন; এমন প্রফেশনাল স্টাদের হাতে” তা পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া উচিৎ।
এ সময় তিনি সঞ্চয়পত্রের সাথে তুলনা করে বলেন, “সঞ্চয়পত্র আজকে কিনে আগামী মাস থেকে রিটার্ন পাচ্ছি। কিন্তু পেনশন স্কিমে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হবে। কর্তৃপক্ষ যদি টাকার অপব্যবহার করে বা দেউলিয়া হয়, তখন ইসলামি ব্যাংকের ডিপোজিটরদের মতো অবস্থা হবে।”
যদিও এ প্রসঙ্গে পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. গোলাম মোস্তফা বলেছিলেন, “এটা রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্যারান্টিযুক্ত প্রোগ্রাম। এখানের কোনও টাকা কোথাও যাবে না, শতভাগ টাকা একাউন্টে থাকবে।”
তিনি জানিয়েছেন, সর্বজনীন পেনশনকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য সময় লাগবে।
“আমাদের মতো একটা দেশে মানুষের কাছে পেনশনের বার্তা দিতে গেলে সময় লাগে। আপনি যদি ইতিহাস দেখেন, জার্মানিতে লেগেছে ৩৩ বছর। সবচেয়ে কম লেগেছে দক্ষিণ কোরিয়া, সেটিও ১১ বছর।”
“আমরা আশা করছি যে আমাদের অত সময় লাগবে না। কিন্তু এক বছরও যথেষ্ট না। এতে সময় লাগবে।”
সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খানও মনে করেন, “সরকার যদি সর্বজননীন পেনশন কর্মসূচিকে সমর্থন করে ও জনগণকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয়”, তাহলে এটি কাজ করবে।
“আমাদের দুর্বলতা, আমরা জনগণের সাথে যোগাযোগ করতে পারি না। বরং, একরকম আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তাদের ওপর চাপিয়ে দেই,” যোগ করেন তিনি।
“পেনশন স্কিম নিয়ে বড় অভিযোগ ছিল, টাকা নিয়ে সরকার আর ফেরত দিবে না। এ কারণে মানুষের ভয় ছিল। তাই, এটিকে জনপ্রিয় করা কঠিন কাজ। তবে এটা ভালো দিক যে বিগত সরকারের সবকিছু ফেলে দেওয়ার প্রবণতা আছে, এই সরকার এক্ষেত্রে সেই পথে হাঁটেনি।”
অর্থনীতিবিদদের সুপারিশে এই স্কিমগুলো করা হয়েছিলো বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
এখানে উল্লেখ্য, গোলাম মোস্তফা জানিয়েছেন, পেনশন স্কিমের বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত মুনাফা চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত হিসাব করে অক্টোবরে গ্রাহকদের অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া হবে।
গ্রাহকরা তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে ঘরে বসেই জমাকৃত অর্থ ও মুনাফার পরিমাণ দেখতে পারবেন।
Source name: bbc bengali