সাকিবের বিদায়ে শেষ হলো সব,একে একে শুকিয়ে যাচ্ছে ফুল, নিভে যাচ্ছে দেউটি—মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘প্রথম সর্গ’ কবিতার এই লাইনগুলো বহু প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। এই লেখার উদ্দেশ্যও একই, কারণ দেশের প্রথম টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটকেও ‘প্রথম সর্গ’ ভাবা হলে, সেই প্রথম সর্গের সব ‘ফুল’ই একে একে শুকিয়ে পড়েছে, আর ‘নিবিছে’ সব দেউটিও।
প্রশ্ন হলো, হঠাৎ এই প্রসঙ্গ কেন? এবং কেন মধুকবির কবিতাকে টেনে এনে দেশের প্রথম টি-টোয়েন্টির সঙ্গে মেলানো? আসলে বিরহ ও বেদনার এমন মুহূর্তে গদ্যের চেয়ে পদ্যের রসই যেন অনুভূতিগুলোকে আরও গভীরভাবে স্পর্শ করে। পরশু কানপুরে সাকিব আল হাসান যখন সংবাদ সম্মেলনে টি-টোয়েন্টি থেকে অবসরের ঘোষণা দিলেন, সেই মুহূর্তটা অনেক ভক্তের জন্যই এক অভ্যন্তরীণ দহন শুরু হওয়ার সময় হয়ে দাঁড়ায়।
সাকিব বলেছেন, ভবিষ্যতে যদি বিসিবি তাকে দলের প্রয়োজনে চায়, তাহলে তিনি ফিরতেও রাজি আছেন। তবে সেই ‘পরবর্তী সময়’ কবে আসবে, আদৌ আসবে কি না, কিংবা ৩৭ বছর বয়সী সাকিবের প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য কতটা কার্যকর হবে—এসব প্রশ্ন এখন অনিশ্চিত। যেহেতু তিনি অবসর ঘোষণা করেছেন, তাই বলা যায়, দেশের হয়ে প্রথম টি-টোয়েন্টিতে খেলা ক্রিকেটারদের মধ্যে শেষ ‘দেউটি’ও নিভে গেল। অথবা বলা যায়, শুকিয়ে গেল শেষ ‘ফুলটিও’।
সাকিবের অবসর ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম টি-টোয়েন্টি খেলা সেই দলটির সকল সদস্যই এখন ‘অতীত’ হয়ে গেলেন।
১৮ বছর এখনো পূর্ণ হয়নি, তবে আর এক মাসও বাকি নেই। আজ ২৯ সেপ্টেম্বর, আর সেই ম্যাচটি হয়েছিল ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর। কোন ম্যাচ? এই প্রশ্নে কিছু ভক্ত দ্বিধায় পড়তে পারেন। তবে বাংলাদেশ ক্রিকেটে এমন অনেক অনুরাগী আছেন, যাঁদের দিন-তারিখ মুখস্থ থাকে। তাই শুধু এটুকু বলা যাক—এটা ছিল বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। ভেন্যু খুলনা, প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে, আর বাংলাদেশ সেই ম্যাচে ৪৩ রানে জয়ী হয়েছিল। মনে পড়ছে, তাই তো?
সাকিবের অবসরের ঘোষণা শুনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জেগেছে, প্রথম টি-টোয়েন্টি খেলা সেই দলটির কেউ কি এখনও আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলছেন? না, আর কেউই অবশিষ্ট নেই। সাকিবই ছিলেন শেষ প্রতিনিধি। তাঁর অবসর ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম টি-টোয়েন্টি খেলা সেই দলটির সবাই ‘অতীত’ হয়ে গেলেন। অর্থাৎ, সেই দলটির আর কেউ এই ফরম্যাটে রইলেন না। সব ‘দেউটি’ই নিভে গেল।
সেই দলের ‘ওরা ১১ জন’-এর মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৮ জন তারকা কিংবা ভারী নাম হয়ে উঠেছেন—শাহরিয়ার নাফীস, আফতাব আহমেদ, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, মাশরাফি বিন মুর্তজা, আবদুর রাজ্জাক, মোহাম্মদ রফিক ও শাহাদাত হোসেন। বাকিদের মধ্যে ফরহাদ রেজা সম্ভাবনাময় পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে কিছু প্রতিশ্রুতি দেখালেও শেষ পর্যন্ত সামান্য প্রতিদান দিতে পেরেছেন।
ফরহাদের ১৩ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ হয়েছিল ২০১৪ সালে। নাজমুস সাদাত ও নাদিফ চৌধুরী আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেননি। ওপেনার নাজমুস সাদাতের সেটাই ছিল একমাত্র আন্তর্জাতিক ম্যাচ। জোরে মারার খ্যাতি নিয়ে জাতীয় দলে আসা নাদিফ চৌধুরী খেলেছেন মাত্র তিনটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ, সবগুলোই টি-টোয়েন্টি সংস্করণে।
তবে যে আটজনের কথা বলা হলো, তাঁদের ক্যারিয়ার দীর্ঘ হয়েছে। কে কবে অবসর নিয়েছেন কিংবা জাতীয় দলের বাইরে ছিটকে যাওয়ার পর আর ফিরতে পারেননি, তা মোটামুটি সবারই জানা। তাই আলাদা করে তাঁদের কারও কারও অবসরের দিন-তারিখ উল্লেখ করা প্রয়োজন নয়, কারণ, ঘোষণা দিয়ে অবসর নেওয়ার সৌভাগ্য সবার হয়নি।
বাংলাদেশের প্রথম টি–টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক ৩৯ বছর বয়সী শাহরিয়ার নাফীস বর্তমানে বিসিবির ক্রিকেট অপারেশনস ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ওই একটি টি–টোয়েন্টি খেলেছেন তিনি, এরপর ২০১১ সালে সর্বশেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে। আফতাব আহমেদ ১১টি টি–টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন, যার শেষটি ছিল ২০১০ সালে। খেলা ছেড়ে দেশে কিছুদিন কোচিং করার পর আফতাব যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান; তিনি বাকি দুই সংস্করণে সর্বশেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচও ২০১০ সালে খেলেছেন।
ওয়ানডে ও টেস্টে খেলা মুশফিকুর রহিম ২০২২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতির মাধ্যমে টি–টোয়েন্টি থেকে অবসর নেন। বাংলাদেশের হয়ে এক শ বা এর বেশি টি–টোয়েন্টি ম্যাচ খেলার কৃতিত্ব যাদের, মুশফিক তাঁদের একজন (১০২)। এই সংস্করণে তাঁর শেষ ম্যাচটি ২০২২ সালের ১ সেপ্টেম্বর দুবাইয়ে এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হয়। ৫৪টি টি–টোয়েন্টি ম্যাচ খেলা মাশরাফি সর্বশেষ খেলেছেন ২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে। দ্বিতীয় টি–টোয়েন্টির টসে তিনি ঘোষণা করেন, পরের ম্যাচটিই হবে তাঁর শেষ টি–টোয়েন্টি।
এখন পরিসংখ্যানের কচকচানি থেকে একটু স্বস্তি পেতে আসি একটি কুইজের মাধ্যমে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে স্পিন-কিংবদন্তি মর্যাদা পাওয়া ওই ক্রিকেটারের নাম বলুন তো, যিনি টি–টোয়েন্টি সংস্করণে মাত্র একটি ম্যাচ খেলেছেন, এবং সেটি ব্যাটিংয়ে ‘ছক্কা রফিক’ খ্যাতি পাওয়ার পরও! ঠিকই ধরেছেন, ২০০৮ সালে বাংলাদেশের হয়ে সর্বশেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা রফিক সেই একমাত্র টি–টোয়েন্টি ম্যাচে অংশগ্রহণ করেন, যা ছিল ওই প্রথম ম্যাচটি।
তখন তাঁর বয়স ছিল ৩৬, যা নিশ্চয়ই টি–টোয়েন্টির জন্য অনেকটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যদিও পরে দেখা গেছে, অধিক বয়সে অনেকেই টি–টোয়েন্টিতে ভালো পারফর্ম করেছেন, কিন্তু সেই সময় বাংলাদেশ ক্রিকেটের অস্থির দিনগুলোতে টি–টোয়েন্টিকে অপেক্ষাকৃত তরুণদের খেলার পর্যায়ে ধরা হতো।
বর্তমানে বিসিবিতে নির্বাচকের দায়িত্ব পালন করা সাবেক বাঁহাতি স্পিনার রাজ্জাক বাংলাদেশ দলের হয়ে ৩৪টি টি–টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন, যার সর্বশেষটি ২০১৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। সাবেক পেসার শাহাদাতের অবস্থানও কম নয়; তিনি ৬টি টি–টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন, যার শেষটি ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হয়েছিল।
এখন সেই আটজনের মধ্যে যে ব্যক্তি বাকি রইলেন, তিনি দেশের হয়ে ১২৯টি টি–টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন। এই সংস্করণে তিনি সর্বোচ্চ ২৫৫১ রান সংগ্রহ করেছেন এবং তাঁর শিকার করা ১৪৯ উইকেট আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টিতে তৃতীয় সর্বোচ্চ। এর পাশাপাশি, এই সংস্করণে অন্য কোনো খেলোয়াড়ের নেই তাঁর মতো ২,০০০ রান এবং ১০০ উইকেটের ‘ডাবল’। আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টিতে সবচেয়ে দীর্ঘ ক্যারিয়ারের অধিকারীও তিনিই। নামটি হয়তো আপনি অনুমান করে ফেলেছেন।
হ্যাঁ, তিনি সাকিব আল হাসান!