কানপুর টেস্টের চতুর্থ দিনের খেলা শেষে সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন মেহেদী হাসান মিরাজ। তখন বাংলাদেশ দুই ইনিংস মিলিয়ে ভারতের প্রথম ইনিংস থেকে ২৬ রানে পিছিয়ে ছিল, হাতে ছিল ৮ উইকেট এবং একদিন বাকি।
সবাই জানত, ভারতের টার্গেট এই ম্যাচ থেকে ফলাফল বের করা, আর বাংলাদেশের জন্য দ্বিতীয় ইনিংস ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ। এককথায়, পরের দিন (আজ) যতটা সম্ভব বেশি সময় ক্রিজে থাকতে হবে, এবং ভারতের সামনে একটি বড় লক্ষ্য দাঁড় করাতে হবে। কারণ, ভারত তাদের প্রথম ইনিংসে ৮.২২ গড়ে ৩০ ওভারের বেশি সময় ব্যাট করেছে, যা তাদের দ্রুত রান সংগ্রহের সক্ষমতার প্রমাণ।
মিরাজ প্রথমে আশাবাদ প্রকাশ করে বলেন, আমরা এখনো হারিনি। আমরা এমন অনেক ম্যাচ জিতেছি এবং এমন অনেক ম্যাচও হয়েছে, যেখানে আমরা ভালো করেছি। এখনো আমাদের জন্য একটি সুযোগ রয়েছে। তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের আগে নিজেদের নিরাপদ করাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, জেতার চিন্তা করার আগে। মিরাজ প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, চেষ্টা করব, যেন আমাদের ব্যাটসম্যানরা আগামীকাল দীর্ঘ সময় ব্যাট করতে পারেন।
ম্যাচে পরিস্থিতি যা দাবি করছে, তার উল্টো পথে হেঁটে কম ওভারসংখ্যার ইনিংসে দ্রুত রান তুলে এমন সব আউট তো বাংলাদেশের চিরন্তন ব্যাটিংয়েরই প্রচ্ছদ।
দুটি বিষয় ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—দলকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া এবং সে জন্য দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাটিং করা। কিন্তু যখন রাত পেরিয়ে গ্রিন পার্কে সকাল হলো, ধীরে ধীরে বোঝা গেল, কেউই সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেননি। চাপের মুখে টেস্ট ব্যাটিংয়ে আবারও দেখা গেল সেই চিরচেনা ‘ক্ল্যাসিক’ বাংলাদেশ।
পঞ্চম ও শেষ দিনে বাংলাদেশ দল টিকল মাত্র ৩৬ ওভার। যে ধরনের ধৈর্যশীল ব্যাটিং প্রয়োজন ছিল, তা দেখা যায়নি, যেমন ছিল না যথেষ্ট ওভারসংখ্যা, তেমনি রানরেটও ছিল মাত্র ৩.৩৩। উইকেট পড়েছে নিয়মিত বিরতিতে। সাদমান–নাজমুলের ৮৪ বলের (৫৫) জুটি ছাড়া কোনো জুটিই ৩৮ বলের বেশি টিকতে পারেনি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৮ বলের জুটি হয়েছে দশম অর্থাৎ শেষ উইকেট জুটিতে।
টেস্টের পঞ্চম দিন বলে খেলায় নজর না রাখলে আপনি হয়তো ভাবতে পারেন, শেষ দিনে ব্যাটিং করা এমনিতেই কঠিন! উইকেট ক্রমশ ভাঙতে থাকে, স্পিনাররা বাড়তি সুবিধা পান, পেসারদের সিম মুভমেন্টও কাজে আসে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, এই টেস্টের প্রথম দিনে ৩৫ ওভার খেলা হওয়ার পর চতুর্থ দিন থেকে আবার খেলা শুরু হয়েছে। প্রথম দিন দেড় সেশনের বেশি খেলা হয়নি এবং পরের দুই দিন বৃষ্টিতে ভেসে গেছে, উইকেট ঢাকা ছিল কাভারে। তাই শেষ দিনেও উইকেট ব্যাটিং সহায়ক ছিল। ভারতের ধারাভাষ্যকার রবি শাস্ত্রীও বলেছিলেন, ‘আজ টেস্টের দ্বিতীয় দিনের উইকেটই আছে।’
সেই অনুযায়ী, বাংলাদেশ তৃতীয় দিনের উইকেটে খেলছিল। কিন্তু উইকেট যেমনই থাক, বাংলাদেশের ‘ক্ল্যাসিক’ ব্যাটিং স্টাইলে ফেরার যেন অভ্যাস! এই ফিরে আসার কথাই উঠছে কারণ, পাকিস্তান সফরে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে নিজেদের এই ‘ক্ল্যাসিক’ ব্যাটিং ভুলে সিরিজ জিতেছিল বাংলাদেশ।
মাত্র ৩৮ রানের লিড নিয়েছে বাংলাদেশ। নাজমুলের কিনা ঠিক তখনই ‘মরিবার হলো তার সাধ’। সেটাও রবীন্দ্র জাদেজার দিনের দ্বিতীয় বলে, রিভার্স সুইপে! আউটটি দেখলে বিশ্বাস হবে না যে বাংলাদেশ টেস্ট দলের অধিনায়কের ‘ম্যাচ অ্যাওয়ারনেস’ এমন!
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশের ‘ক্ল্যাসিক’ ব্যাটিং বলতে আসলে কী বোঝায়? ক্ল্যাসিক মানে তো চিরন্তন—যতই পরিবর্তন আসুক, ভেতরের বুনিয়াদি সমস্যাগুলো মাঝে মাঝে নিজ থেকেই প্রকাশ পায়। ঠিক তেমনই কানপুরে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংসের আউটগুলো ছিল সেই চিরচেনা দৃশ্য—ভালো খেলার পর হঠাৎ আউট, মনোযোগ হারিয়ে আউট, ভুল থেকে শিক্ষা না নেওয়া আউট, এবং হ্যাঁ, ব্যাখ্যাতীত শট খেলে আউটও।
বাংলাদেশ মাত্র ৩৮ রানের লিড নিতে পেরেছিল। ঠিক তখনই নাজমুলের অদ্ভুতভাবে আউট হওয়ার ঘটনা ঘটে, সেটাও ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনা না করেই। রবীন্দ্র জাদেজার দিনের দ্বিতীয় বলেই তিনি রিভার্স সুইপ খেলে আউট হন, যা দেখে মনে হয়নি যে এটি টেস্ট অধিনায়কের সঠিক ‘ম্যাচ অ্যাওয়ারনেস’।
ম্যাচের পরিস্থিতি যা দাবি করছিল, তার ঠিক উল্টো পথে হেঁটে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা দ্রুত রান তুলতে গিয়েই আউট হয়েছেন। এটি যেন সেই চিরন্তন ব্যাটিং ধাঁচেরই প্রতিচ্ছবি।
সাদমান কিছুটা ব্যতিক্রম ছিলেন। তবে ১০১ বল খেলার পর গালিতে যে ক্যাচ তুলে দিলেন, সেটিকে কী বলবেন? তিনি ‘ফুল ব্লাড’ কাট না খেলার চেষ্টা করলেও, তার আউটও ভালো খেলতে খেলতে হঠাৎ আউট হওয়ার আরেক উদাহরণ। এর আগে মুমিনুলের আউটটি? দিনের তৃতীয় ওভারে লেগ স্টাম্পের বাইরে গিয়ে সুইপ খেলতে গিয়ে ব্যাটের কানায় লাগিয়ে আউট হন। দুর্ভাগা বলতে পারেন, তবে ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী এমন শট খেলার কোনো প্রয়োজন ছিল না। সকালের সেশনে স্বাভাবিক ব্যাটিং করে কাটানোর মনোভাব থাকলে, ওই সুইপ শটটি তখনকার পরিস্থিতিতে বেমানান ছিল।
তবে ম্যাচে হারের স্পষ্ট ইঙ্গিত প্রথমে আসে মুমিনুলের আউট থেকে নয়, বরং স্বয়ং অধিনায়ক নাজমুলের আউট থেকেই। ২৭ ওভারে বাংলাদেশের রান ছিল ৩ উইকেটে ৯০। বর্ধিত প্রথম সেশন শেষ হতে তখনো প্রায় ২০ ওভার বাকি, আর লিড মাত্র ৩৮ রান। ঠিক তখনই নাজমুল এমন একটি শট খেলেন যা পরিস্থিতির সঙ্গে একদমই মানানসই নয়—রবীন্দ্র জাদেজার দিনের দ্বিতীয় বলেই রিভার্স সুইপ খেলার চেষ্টা, ফলাফল বোল্ড! আউটটি দেখে বিশ্বাস করা কঠিন যে এটি একজন টেস্ট অধিনায়কের ‘ম্যাচ অ্যাওয়ারনেস’। জাদেজার লেগ স্টাম্পের বলটিকে অফসাইডে রিভার্স সুইপ করতে গিয়েই বোল্ড হন নাজমুল।
নাজমুলের সেই আউটের পর থেকেই ভেতরে ভেতরে ভয়ের ঢেউ বয়ে যেতে শুরু করে। এরপর কী হলো? ২৪ বলের মধ্যেই বাংলাদেশের স্বীকৃত শেষ ব্যাটিং জুটি ক্রিজে হাজির! এই ২৪ ডেলিভারির মধ্যে আউট হন সাদমান, লিটন এবং সাকিব আল হাসান।
টেস্টে বাংলাদেশের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও কুশলী ব্যাটসম্যান উইকেটে থাকতে এবং এড়ানোর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও লোয়ার অর্ডারের বুমরার মুখোমুখি হওয়া কতটা স্বস্তিদায়ক দৃশ্য?
লিটনের আউটটি যেন একেবারে মনোযোগ হারিয়ে ফেলার উদাহরণ। জাদেজার অফ স্টাম্পের চারটি বল ছেড়ে দেওয়ার পর শেষ বলটি একটু উঠেছিল, লিটন বলটা দেখতে দেখতে শেষ মুহূর্তে গ্লাভসে ছুঁয়ে দিলেন। যেন কিছুই করার ছিল না! সাকিবের আউটটিও ছিল বেশ অস্বাভাবিক। মাঠের বাইরের চাপ যে সাকিবের মধ্যেও প্রভাব ফেলতে পারে, তা প্রমাণ হয় তার এই আউট দেখে। এমন একটি বল, যা সপাটে ড্রাইভ করার কথা, সেটি তিনি যেন আলতো করে জাদেজার হাতে তুলে দেন, যেন হাতে তুলে দেওয়া কোনো মিষ্টির মতো!
যদিও এত সমালোচনা হলো, তারপরও কিন্তু ম্যাচে লড়াই করার সুযোগ ছিল। মিরাজ ও মুশফিকের শেষ স্বীকৃত ব্যাটিং জুটি (৩২ বলে ২৪) থেকে বাংলাদেশ পাল্টা প্রতিরোধের আশা দেখছিল। কিন্তু মিরাজের আউটের পর ‘লেজ’ বের হয়ে গেলেও অন্য প্রান্তে ছিলেন ‘মাথা’—মুশফিকুর রহিম, বাংলাদেশের টেস্টে সবচেয়ে অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান। এমন পরিস্থিতিতে সবারই আশা ছিল যে, মুশফিক দলের হয়ে পাল্টা লড়াই করবেন।
তবে সেই লড়াই করার একটাই উপায় ছিল—লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানদের প্রতিপক্ষের সেরা বোলারদের মুখোমুখি না হতে দেওয়া, বিশেষ করে ডেথ ওভারের বিশেষজ্ঞ যশপ্রীত বুমরার মতো বোলারের। কিন্তু মিরাজ আউট হওয়ার পর যখন তাইজুল ইসলাম উইকেটে আসেন, তখন দেখা গেল তাইজুলকে ১৩টি বল খেলতে হয়, যার সব কটিই বুমরার। ৩৭তম ওভারের তৃতীয় বলে মিরাজ আউট হওয়ার পর তাইজুলকে শেষ তিনটি বল মোকাবিলা করতে হয়।
৩৮তম ওভারের শেষ দুই বলে মুশফিক দুটি চার মারেন, বিশেষ করে এক্সট্রা কাভার দিয়ে শেষ বলে করা শটে সিঙ্গেল নেওয়ার সুযোগ ছিল, কিন্তু তা নেননি। তখন সবাই জানতেন, পরের ওভারেই বুমরা আসবেন এবং তাঁর লক্ষ্য হবে তাইজুল। মুশফিক যদি সেই বলেই সিঙ্গেল নিয়ে তাইজুলকে বুমরার মুখোমুখি না হতে দিতেন, হয়তো পরিস্থিতি ভিন্ন হতোমুশফিক কি ভেবেছিলেন, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তাইজুলের দুটি ফিফটি আছে বলে তিনি পারবেন? প্রথমে তাইজুল সত্যিই পেরেছিলেন বুমরাকে ঠেকাতে। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি তা ধরে রাখতে পারেননি। বুমরার পরের ওভারে মুশফিক শেষ বলে সিঙ্গেল নিতে পারেননি, ফলে আবারও তাইজুল বুমরার মুখোমুখি হন। ৪১তম ওভারে বুমরার তিনটি বল ঠেকানোর পর চতুর্থ বলেই তাইজুল আউট হন।
অনেকে হয়তো মনে করবেন, মুশফিকের এই ভুলে তাইজুলের আউটের পেছনেও কিছুটা ‘অবদান’ ছিল!
৩৭তম ওভারের তৃতীয় বলে মিরাজ আউট হওয়ার পর বাকি তিনটি বল খেলেন তাইজুল। পরের ওভারের শেষ দুই বলে মুশফিক দুটি চমৎকার চার মারেন, বিশেষ করে শেষ বলে এক্সট্রা কাভার দিয়ে মারা শটটিতে সিঙ্গেল নেওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু সবারই জানা ছিল, পরের ওভারে বুমরা আসবেন, যার লক্ষ্য হবে তাইজুল। সেই পরিস্থিতিতে ৩৮তম ওভারের শেষ বলে মুশফিক যদি একটি সিঙ্গেল নিতেন, তাহলে তাইজুলকে বুমরার মুখোমুখি হতে থেকে বাঁচানো যেত।
মুশফিক কি ভেবেছিলেন, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তাইজুলের দুটি ফিফটি আছে বলে তিনি একাই পারবেন? আসলে তাইজুল পেরেও গেছেন। পরের ওভারে তিনি বুমরাকে ঠেকিয়ে দেন। কিন্তু টেস্টে বাংলাদেশের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও দক্ষ ব্যাটসম্যানের উপস্থিতিতে এবং এই পরিস্থিতিতে এড়ানোর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও লোয়ার অর্ডারের বুমরার মুখোমুখি হওয়া কতটা স্বস্তিদায়ক ছিল?
অবশেষে তাইজুল শেষ পর্যন্ত পারেননি। বুমরাকে ঠেকিয়ে দেওয়ার পরের ওভারেও মুশফিক শেষ বলে সিঙ্গেল নিতে পারেননি। ফলে ৪১তম ওভারে গিয়ে বুমরার তিনটি বল মোকাবিলা করার পর যা ঘটার, তা-ই ঘটে—তাইজুল আউট হন। অনেকে হয়তো সেই আউটে মুশফিকের ‘অবদান’ও দেখতে পারেন!
তবে ৩৭ রান ছাড়াও মুশফিকের ‘অবদান’ রয়েছে আরও। লাঞ্চের আগে খেলা শেষ বলটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্রিজের অন্য প্রান্তে ছিলেন শেষ ব্যাটসম্যান। শেষ বলটি যদি তিনি কোনোভাবে ঠেকিয়ে দিতে পারতেন, তাহলে অন্তত ৪০-৪৫ মিনিটের বিরতি নেওয়া যেত। এরপর নতুন করে শুরু করা সম্ভব হতো। কিন্তু মুশফিক কী করলেন?
বুমরার স্লোয়ার মেশানো শেষ বলটি একটু সামনে পড়ায় তিনি ওভার দ্য টপ শট খেলতে গেলেন। বাউন্ডারি লক্ষ্য করলেও ব্যাটে সঠিকভাবে না লাগায় তিনি বোল্ড হয়ে গেলেন। এই অভিজ্ঞতা থেকেই মনে হয়, অভিজ্ঞতার মূল্য বোঝা উচিত ছিল!