বাংলাদেশে চরম দারিদ্র্যে, বিশ্বব্যাপী দরিদ্র মানুষের প্রায় দুই–তৃতীয়াংশের বসবাস মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে।
- দরিদ্র মানুষের ৮৩ দশমিক ৭ শতাংশ গ্রামে বসবাস করেন।
- দারিদ্র্যের মধ্যে থাকা জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বেশির বয়স ১৮ বছরের কম।
বাংলাদেশে ৪ কোটি ১৭ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছে, এর মধ্যে ৬.৫ শতাংশের অবস্থা গুরুতর। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
‘বৈশ্বিক বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক-২০২৪: সংঘাতের মধ্যে দারিদ্র্য’ শিরোনামে বৃহস্পতিবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কেন্দ্র অক্সফোর্ড পোভার্টি অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করা হয়েছে। এতে ১১২টি দেশের ৬৩০ কোটি মানুষের ওপর গবেষণা করা হয়েছে, যা ২০২২-২৩ পর্যন্ত এক দশকের বেশি সময়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে আবাসন, পয়োনিষ্কাশন, বিদ্যুৎ, ভোজ্যতেল এবং পুষ্টির মতো মৌলিক সেবার অভাব এবং শিশুর স্কুল উপস্থিতি নিয়ে তথ্য দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনের অনুযায়ী, বিশ্বের ১১০ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে, যাদের প্রায় অর্ধেকই সংঘাতকবলিত দেশগুলোর বাসিন্দা। চরম দারিদ্র্যের শিকার জনগণের ৮৩ শতাংশ আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বসবাস করছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ২৭ কোটি ২০ লাখ দরিদ্র মানুষ এমন পরিবারে রয়েছে, যেখানে অন্তত একজন ব্যক্তি অপুষ্টিতে ভুগছেন।
বৈশ্বিক বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক-২০২৪ অনুযায়ী, বাংলাদেশে দারিদ্র্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে মানুষের জীবনযাত্রার মান (৪৫.১%)। এরপর রয়েছে শিক্ষা (৩৭.৬%) এবং স্বাস্থ্য (১৭.৩%)।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের সর্বশেষ তথ্যমতে, দেশের ১৮.৭% জনসংখ্যা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে, এর মধ্যে ৫.৬% মানুষ অতি দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে। সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার, যার ভিত্তিতে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৩ কোটি ১৭ লাখ ৫৭ হাজার।
এই বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এর সাবেক মহাপরিচালক কে এ এস মুর্শিদ বলেছেন, ইউএনডিপির এই সমীক্ষায় বাংলাদেশের দারিদ্র্য পরিমাপ করার পদ্ধতি এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বা অন্যান্য সংস্থার সমীক্ষার মধ্যে তুলনা করা উচিত নয়। এই সমীক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতির বৈশ্বিক অবস্থান বোঝা সম্ভব হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরে বাংলাদেশের ডলার সংকট এবং অন্যান্য আর্থিক সমস্যার কারণে দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে, যা বিভিন্ন সূচকের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে। এই তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
বৈশ্বিক বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক-২০২৪ অনুযায়ী, বাংলাদেশে দারিদ্র্যের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখছে মানুষের জীবনযাত্রার মান, যা ৪৫.১ শতাংশ। এর পরের অবস্থানে রয়েছে শিক্ষা (৩৭.৬ শতাংশ) এবং স্বাস্থ্য (১৭.৩ শতাংশ)।
সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী শিশুরা
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষের বসবাস ভারতে, যেখানে ১৪০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ২৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে আছেন। এর পরের অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান (৯ কোটি ৩০ লাখ), ইথিওপিয়া (৮ কোটি ৬০ লাখ), নাইজেরিয়া (৭ কোটি ৪০ লাখ) এবং কঙ্গো প্রজাতন্ত্র (৬ কোটি ৬০ লাখ)। বিশ্বের চরম দারিদ্র্যে থাকা জনগণের প্রায় অর্ধেকই এই পাঁচটি দেশের বাসিন্দা।
ইউএনডিপি প্রকাশিত এক সূচকে দেখা যাচ্ছে, দারিদ্র্যের প্রধান ভুক্তভোগী শিশুরা। চরম দারিদ্র্যে থাকা ৫৮ কোটি ৪০ লাখের মধ্যে প্রায় ১৮ বছরের কম বয়সী। এই সংখ্যা বিশ্বের মোট শিশুর ২৭.৯ শতাংশ, যেখানে চরম দারিদ্র্যে রয়েছে বিশ্বের মোট প্রাপ্তবয়স্কের ১৩.৫ শতাংশ।
এছাড়া, ইউএনডিপির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চরম দারিদ্র্যের মধ্যে থাকা ৪৫ কোটি ৫০ লাখ মানুষ সংঘাত-সহিংসতার পরিস্থিতিতে বাস করছে। সংঘাতপূর্ণ দেশগুলোতে শিশুমৃত্যুর হার ৮ শতাংশ, অন্যদিকে শান্তিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য এই হার মাত্র ১.১ শতাংশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে বসবাসরত মানুষ পুষ্টি, বিদ্যুৎ, পানি ও পয়োনিষ্কাশনের মত মৌলিক সুবিধা থেকে চরমভাবে বঞ্চিত।
ইউএনডিপি প্রকাশিত এক সূচকে দেখা গেছে, দারিদ্র্যের প্রধান ভুক্তভোগী হচ্ছে শিশুরা। চরম দারিদ্র্যে থাকা ৫৮ কোটি ৪০ লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় ১৮ বছরের কম বয়সী। এই সংখ্যা বিশ্বের মোট শিশুর ২৭.৯ শতাংশ, যেখানে চরম দারিদ্র্যে রয়েছে বিশ্বের মোট প্রাপ্তবয়স্কদের ১৩.৫ শতাংশ।
ইউএনডিপির কর্মকর্তা আচিম স্টেইনার বলেন, ‘গত কয়েক বছরে সংঘাত বেড়ে কয়েক গুণ হয়েছে। এতে প্রাণহানি নতুন করে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সংঘাতের জেরে রেকর্ড পরিমাণ মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন। এতে বড় পরিসরে মানুষের জীবন ও জীবিকা বাধার মুখে পড়ছে।’
এই সংঘাত বন্ধ ছাড়া দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব নয় বলে মনে করেন অক্সফোর্ড পোভার্টি অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভের পরিচালক সাবরিনা আলকায়ার। তিনি বলেন, সংঘাতপূর্ণ দেশগুলোয় দারিদ্র্য বিমোচনের গতি তুলনামূলক কম। তাই বলা যায়, এসব দেশের দরিদ্র মানুষকে দূরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিনিয়োগ ছাড়া দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব নয়।
গত কয়েক বছরে সংঘাত বেড়ে গিয়েছে, যার ফলে প্রাণহানি নতুন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সংঘাতের ফলে রেকর্ড পরিমাণ মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, এবং এর প্রভাবে ব্যাপকভাবে মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপর্যস্ত হচ্ছে।
ইউএনডিপির কর্মকর্তা আচিম স্টেইনার